Header Ads

test

সাক্ষ্য দেয়া যাবে মুখোশ পরেও

সুপ্রিমকোর্টের খসড়া নীতিমালা



অধস্তন আদালত বা ট্রাইব্যুনালে কোনো মামলার সাক্ষীকে তলব করা হলে সেদিনই তার সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন করতে হবে। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ না করে তাকে ফেরত পাঠানো যাবে না। শুধু তাই নয়, কোনো সাক্ষী হুমকিতে থাকলে তিনি মুখোশ পরে কিংবা কাঠগড়ার পাশে অস্বচ্ছ পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিতে পারবেন।

এসব বিধানসহ বেশকিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে ‘অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের জন্য সাক্ষী ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’র খসড়া প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট। বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ আদালতের ওয়েবসাইটে ১৯ পৃষ্ঠার এ খসড়াটি প্রকাশ করা হয়। ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ ব্যাপারে মতামত দিতে অধস্তন আদালতে কর্মরত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাসহ অন্য অংশীজনকে আহ্বান করা হয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট যেদিন থেকে নির্দেশ দেবেন সেদিন থেকে এটি কার্যকর হবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়। এতে আরও বলা হয়, জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি বা ইউএনডিপির অর্থায়নে এ নীতিমালার খসড়াটি প্রস্তুত করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য সাক্ষ্য ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করে মামলার জট, সময় ও ব্যয় কমানো এবং সাক্ষীদের বারবার উপস্থিতি রোধ করা। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (বিচার ও প্রশাসন) সাব্বির ফয়েজ মঙ্গলবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, নিন্ম আদালতে সাক্ষী ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে নীতিমালাটি চূড়ান্ত করে সার্কুলার জারি করা হবে। এটা করা হবে ফৌজদারি কার্যবিধির আলোকেই। তিনি আরও জানান, অধস্তন আদালতে বিচার সংক্রান্ত আরও অনেক সার্কুলার এর আগে সুপ্রিমকোর্ট জারি করেছেন এবং তা বাস্তবায়নও হয়েছে। 

নীতিমালার খসড়ায় বলা হয়েছে, সাক্ষীকে তার একদিনের মজুরির সমান টাকা, তিন বেলা খাওয়ার অর্থ ও যাতায়াত খরচ দিতে হবে। তবে কোনো সাক্ষী যুক্তিসঙ্গত অজুহাত ছাড়া আদালতে হাজির হতে অবহেলা দেখালে কিংবা গরহাজির থাকলে তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পুলিশি চার্জশিটে সাক্ষীর মোবাইল ফোন নম্বর ও ই-মেইল উল্লেখ থাকতে হবে। 

খসড়ায় আরও বলা হয়, ফৌজদারি মামলার সফলতার জন্য সাক্ষীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাক্ষীদের মৌখিক প্রমাণের ওপর আদালত বহুলাংশে নির্ভরশীল। তাদের জেরার মাধ্যমে অভিযোগের সত্যাসত্য নির্ধারিত হয়। খসড়া নীতিমালার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, কেউ যেন অপরাধ করে পার না পায় এবং আদালতের ওপর আস্থা বৃদ্ধি পায়। আদালত ও ট্রাইব্যুনালকে সাক্ষীবান্ধব বানানো এ নীতিমালার উদ্দেশ্য। 

সুপ্রিমকোর্ট প্রণীত এ খসড়ায় বলা হয়েছে, শুধু বিচারকের অসুবিধার কারণে যেন কোনো সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ না করে ফেরত পাঠানো না হয়। যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া একাধিক দিনে কিংবা একদিনে কয়েক দফায় কোনো সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ কিংবা জেরা করা যাবে না। তবে পুনরায় জেরা করার প্রয়োজন হলে সাক্ষীকে তলব করা যাবে। 

বিচারকদের উদ্দেশে খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, একদিনে যতজনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্ভব, তার বেশি সাক্ষীকে যেন তলব করা না হয়। সাক্ষীদের সঙ্গে সম্মানজনক ও স্বচ্ছ আচরণ করতে হবে। একদিনে অনধিক ৫ জন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ও ১৫ জন সাধারণ সাক্ষীকে (সর্বোচ্চ ২০ জনকে) তলব করা যাবে।  কোনো বিচারক যদি সময় স্বল্পতা কিংবা অসুস্থতার কারণে উপস্থিত সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ না করতে পারেন তাহলে সমমানের অন্য আদালতে তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা শেষ করতে হবে। 

কোনো সাক্ষী হুমকি পেয়ে থাকলে তাকে পুলিশি নিরাপত্তায় বিশেষ পথে আদালতে হাজির করতে ও আদালত কক্ষ ছাড়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। থাকতে হবে আলাদা বিশ্রামাগার (ওয়েটিং রুম)। কাঠগড়ার পাশে তার জন্য একটি অস্বচ্ছ বা অন্ধকার পর্দা থাকবে যাতে সাক্ষী অভিযুক্তকে দেখতে পারেন কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তি সাক্ষীকে দেখতে না পারেন। তবে পর্দাটি এমনভাবে বসাতে হবে যাতে বিচারক ও আইনজীবীরা সাক্ষীকে দেখতে পারেন। খড়সায় বলা হয়েছে, আইন সংশোধন করে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঝুঁকিতে থাকা সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা যায় কিনা সেটি ভেবে দেখতে হবে। কোনো সাক্ষী হুমকিতে থাকলে তিনি মুখোশ ও হিজাব পরে সাক্ষ্য দিতে পারবেন।

সাক্ষীদের প্রয়োজনীয় তথ্য লিফলেট আকারে বিতরণ করতে হবে। সাক্ষীদের অপেক্ষা করার জন্য পর্যাপ্ত বসার ব্যবস্থা ও তাতে ওয়াশরুম থাকতে হবে। প্রতিটি আদালতে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার বা শিশুদের দুধ খাওয়ানোর উপযোগী পরিবেশ ও বিনামূল্যে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা থাকতে হবে। সাক্ষীদের জন্য হেল্প ডেস্কের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিশ্রামাগারে সাক্ষী ছাড়া কেউ থাকতে পারবেন না। নারীদের জন্য রাখতে হবে আলাদা বসার ব্যবস্থা। 

খড়সা নীতিমালায় বলা হয়েছে, সাক্ষীদের আদালতে আসা-যাওয়া, তার একদিনের সমপরিমাণ আয় ও তিন বেলার খাবারের টাকা দিতে হবে। এছাড়া আদালতে কোনো ডকুমেন্ট উপস্থাপন করা হলে সেজন্য প্রযোজ্য খরচও দেবেন আদালত। ফৌজদারি আইনের ৫৪৪ ধারায় এ নির্দেশ রয়েছে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়। উপযুক্ত সফটওয়্যারের মাধ্যমে সাক্ষীর জবানবন্দি টাইপ করে রাখতে হবে। 

খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, অতীত রেকর্ড থেকে দেখা যাচ্ছে যে, কোনো সাক্ষী হাজির হতে ব্যর্থ হলে জামিন অযোগ্য সাক্ষী ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়। পুলিশ তাদের হাজির করলে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ না করে পাঠিয়ে দেয়া যাবে না। সরকারি উকিল বা পাবলিক প্রসিকিউটররা (পিপি) কোনো সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করতে অপারগ হলে তাকে তা লিখিতভাবে জানাতে হবে। কোনো পিপির উদাসীনতা পরিলক্ষিত হলে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। কোনো সাক্ষী যুক্তিসঙ্গত অজুহাত ছাড়া আদালতে হাজির হতে অবহেলা দেখালে কিংবা গরহাজির থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনবার আদালতের তলবে সাড়া না দিলে আদালতকে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। 

খসড়া নীতিমালা কার্যকর হওয়ার পর তিন মাস পরপর সুপ্রিমকোর্টের মনিটরিং সেলে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠাতে হবে। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে মনিটরিং সেল এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আদেশ দেবে। 
২০১৫ সালের ৭ ডিসেম্বর ফৌজদারি মামলায় সাক্ষীদের নিরাপত্তা এবং নির্ধারিত তারিখে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হাইকোর্ট সরকারকে সাক্ষী সুরক্ষা আইন করার নির্দেশ দেন। একটি হত্যা মামলায় ৬ বছরে একজনও সাক্ষ্য না দেয়ায় এ আদেশ দেন হাইকোর্ট।

তারও আগে ২০১১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আইন কমিশন ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন’ প্রণয়নের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে একটি খসড়া প্রেরণ করে। কমিশন তাদের সুপারিশমালায় সুরক্ষার অধিকার, সুরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য জানার অধিকার, সুরক্ষা বিষয়ে জাতীয় নীতিমালা কর্মসূচি ও বাস্তবায়ন সংস্থা, সুরক্ষা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তির আবেদন, আবেদনের শর্তাবলী, সুরক্ষাপ্রাপ্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি (ভিকটিম) বা সাক্ষীর অধিকার, সাক্ষীদের অধিকার ভোগ নিশ্চিত করা, সাক্ষীর অঙ্গীকার, সাক্ষীর নিরাপত্তাসহ ১৯টি সুপারিশ প্রেরণ করে।

এদিকে আইন কমিশনের সুপারিশ ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয়নি ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন’। স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিলেও এখন পর্যন্ত আইন প্রণয়নের কার্যক্রম সম্পন্ন করা যায়নি। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যুগান্তরকে বলেন, সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছে মন্ত্রণালয়। আইনটি চূড়ান্তকরণে সংশ্লিষ্ট বিভাগ কাজ করছে, আশা করা যাচ্ছে দ্রুত সম্পন্ন হবে।

No comments

Thanks for your valuable comment!