যুক্তরাষ্ট্র ভেঙে যাবে?
যুক্তরাষ্ট্র ভেঙে যাবে? |
মঈনুল আলম
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭,রবিবার, ১৪:৪২
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়ে দেশ পরিচালনার সাত মাসেই আমেরিকার বিশেষজ্ঞ মহলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র কতখানি ‘যুক্ত’ থাকবে তা নিয়ে।
ট্রাম্প শাসনের তিন মাসের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিন আমেরিকায় দ্বিতীয়বার গৃহযুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা কী রকম, সে সম্পর্কে জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের অভিমতের এক জরিপ চালিয়েছে। সর্বাধিকসংখ্যক বিশেষজ্ঞ বলেন, শতকরা ৩০ ভাগ আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। স্বল্পসংখ্যক বিশেষজ্ঞ বলেন, দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা শতকরা ৬০ থেকে ৯৫ ভাগ।
প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ‘নিউ ইয়র্কার’ গত সপ্তাহের সংখ্যায় ‘‘Is America headed for a new kind of Civil War’’? (আমেরিকা কি এখন নতুন ধরনের গৃহযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে?) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। এ প্রবন্ধের ওপর মন্তব্য করে সাংবাদিক রবিন রাইট প্রশ্ন রেখেছেন : ‘আমাদের ইউনিয়ন, আমাদের রিপাবলিক যেটাকে দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বের সবচেয়ে স্থিতিশীল গণতন্ত্র বলে বিবেচনা করা হতো, সেটা এখন কী রকম ভঙ্গুর হয়ে উঠেছে!’
এ বিশেষজ্ঞদের অন্যতম কিথ মাইনস, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী, স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও জাতিসঙ্ঘে দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয়বার গৃহযুদ্ধ বেধে যাওয়ার পাঁচটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি উল্লেখ করেছেন : ‘জাতি গভীরভাবে দ্বিধাবিভক্ত’ হয়ে যাওয়া; জাতিকে বিভাজন করার মতো মিডিয়ায় কনটেন্টস পরিবেশন; প্রেস ও জুডিশিয়ারির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলায়ন; রিপাবলিকান পার্টির নেতৃত্বের পুরোপুরি বিকিয়ে যাওয়া এবং বিরোধ নিরসনে ‘সহিংস পদ্ধতিকে বৈধ বলে গ্রহণ করা আর শক্তি প্রয়োগে নিজের পথ পরিষ্কার করা’।
যেসব ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ বেধে যেতে পারে, মাইনস সেগুলো উল্লেখ করেছেন : সন্ত্রাসী আক্রমণ; অর্থনৈতিক চরম অবনতি; সাম্প্রদায়িক কোনো ঘটনা, যার প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে; প্রেসিডেন্টকে ‘ইমপিচ’ করা হলে অথবা তিনি যদি প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অপসারিত হন। মাইনস বলেন, ‘প্রত্যেক আমেরিকান এখন উত্তেজিত হয়ে আছে কোনো না কোনো কারণে এবং তার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে।’
মাইনস নাম উল্লেখ না করলেও প্রেসিডেন্ট বলতে স্পষ্টত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকেই বুঝিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রাষ্ট্র পরিচালনার এই সাত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদপত্রগুলো এবং শক্তিশালী কলামিস্ট ও মিডিয়াব্যক্তিত্বদের বেশির ভাগ ট্রাম্প সম্পর্কে যেসব অভিমত ও মন্তব্য প্রকাশ করেছেন এর সারাংশ হচ্ছে : ডোনাল্ড ট্রাম্প অজ্ঞ, মিথ্যাবাদী, নার্সিসিস্ট (আত্ম-অহঙ্কারে মগ্ন), মৌলিক শিষ্টাচার দেখাতেও অক্ষম এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য ন্যূনতম যেসব যোগ্যতা থাকা দরকার, সেসব যোগ্যতাবর্জিত।
২২ আগস্ট ফিনিক্সে ৭৫ মিনিট ধরে দেয়া এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাংবাদিকদের গালি দিলেন এই বলেÑ ‘ওরা সব দুষ্ট মানুষ, যারা আমার দেশকে ভালোবাসে না’। তিনি আরো হুমকি দিলেন মেক্সিকো সীমান্তে তার প্রস্তাবিত প্রাচীর নির্মাণের জন্য যদি কংগ্রেস অর্থ মঞ্জুর না করে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বন্ধ (শাটডাউন) করে দেবেন। তার এ বক্তৃতার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের সাবেক ডিরেক্টর জেমস ক্লেপার বলেন : ‘আমি কোনো প্রেসিডেন্টকে এমন বেপরোয়া ও দায়িত্বহীন ভাষণ দিতে দেখিনি। আমি প্রশ্ন করছি তার প্রেসিডেন্ট পদে থাকার যোগ্যতাকে। তার এভাবে বক্তব্য দেয়ার পেছনে মতলব কী? হয়তো তিনি এ পদ থেকে সরে যাওয়ার জন্য একটি পথ খুঁজছেন।’
এর পরে রিপাবলিকান সিনেটর বব কর্কার, যিনি সিনেটের ফরেন রিলেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট হতে হলে মনের যে দৃঢ়তা ও অন্যান্য যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন. তিনি সেসব এখনো দেখাতে পারেননি।’
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অজ্ঞতা এবং তার স্বার্থসিদ্ধির জন্য বেপরোয়াভাবে চরম মিথ্যা বলার উদাহরণ রাখলেন ১৬ আগস্ট, তার পরম শত্র“ মুসলিমদের বিরুদ্ধে উনিশ শতকের প্রথম দিকে ফিলিপাইনে অভিযানে এক মার্কিন জেনারেল বন্দী মুসলিম ‘সন্ত্রাসীদের’ কিভাবে হত্যা করেছিল তার প্রশংসা করে তার টুইটারে লিখলেন : ‘এরপর ৩৫ বছর ধরে কোনো মুসলিম চরমপন্থীর আবির্ভাব ঘটেনি’।
এ সম্পর্কে ‘কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশন্সের মুখপাত্র ইব্রাহিম হুপার বলেন, ‘মুসলিমবিরোধিতা হচ্ছে ট্রাম্পের অন্যতম মূল বাণী। ট্রাম্পের বক্তব্যগুলোয় অনবরত মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা (যুক্তরাষ্ট্রের) মুসলিম সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বাস্তবিক উদ্বেগের সঞ্চার করছে।’
গত বছর (২০১৬) নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প তার মুসলিমবিদ্বেষ চরমভাবে প্রকাশ করতে থাকেন শ্বেতাঙ্গ অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ভোটারদের সমর্থন লাভের জন্য। ১৯০০ সালের প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইন দখল করার পর মার্কিন জেনারেল জন পার্শিং কর্তৃক ফিলিপাইনে মুসলিম ‘সন্ত্রাসীদের’ শায়েস্তা করার এক কল্পকাহিনী তিনি বয়ান করতে থাকেন সোৎসাহে।
ট্রাম্প সম্পূর্ণ বানোয়াট ঘটনাটি সোৎসাহে বর্ণনা করেন এভাবে : ‘তিনি (জেনারেল পার্শিং) তার সৈন্যদের রাইফেলের গুলিগুলোকে শূকরের রক্তে ডুবিয়ে সেগুলো বন্দুকে ভরতে আদেশ দিলেন। ৫০ জন (মুসলিম) বন্দীকে লাইন করে দাঁড় করানো হলো। তারপর ৪৯ জন বন্দীকে গুলি করে মেরে ফেলা হলো। শুধু একজনকে অক্ষত রাখা হলো। জেনারেল পার্শিং তাকে বললেন, তোমার লোকজনের কাছে ফিরে যাও এবং তাদের বলো, এখানে কী করা হলো।’ ট্রাম্প গদগদ স্বরে বলতে লাগলেন, ‘এরপর ২৫ বছর ধরে সেখানে কোনো সমস্যা হয়নি। বুঝে দেখো।’
ইব্রাহিম হুপার বলেন, ‘ট্রাম্প সব সময় মিডিয়াকে মিথ্যা সংবাদ বলে উড়িয়ে দেন, তিনি সোৎসাহে জেনারেল পার্শিংয়ের সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বানোয়াট কাহিনী তার নির্বাচনী প্রচারণায় প্রচার করলেন!’
এমন এক মিথ্যাবাদী এবং অনাস্থাভাজন ব্যক্তির নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র কোন পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে? এ প্রশ্ন এখন মার্কিন নাগরিকদের ক্রমেই উদ্বিগ্ন করে তুলছে।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, প্রবাসী
Source: http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/254445
Post a Comment