ভূরাজনীতিযুদ্ধের পথে ট্রাম্প
১৫ বছর আগে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ঘোষণা দিয়েছিলেন, ইরাক, ইরান ও উত্তর কোরিয়া ‘অশুভ অক্ষ’ গঠন করেছে। আর এবার ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতিসংঘের উদ্বোধনী ভাষণে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার সমালোচনা করতে গিয়ে বুশের মতোই বিষ ঢেলে দিলেন। কথারও পরিণতি আছে। ট্রাম্প বৈশ্বিক শান্তির জন্য মারাত্মক এক তাৎক্ষণিক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ২০০২ সালে বুশের কথার কারণে যেটি ঘটেছিল। ওই সময়, অর্থাৎ ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায় বুশ যে অবস্থান নিয়েছিলেন, সে জন্য তিনি ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিলেন। মানুষকে যুদ্ধের দিকে টেনে আনা সহজ, বিশেষ করে ৯/১১-এর পর। তা সত্ত্বেও মার্কিন সমরযন্ত্র আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান ও উত্তর কোরিয়া ফ্রন্টে বৈশ্বিক আস্থা, মানুষের জীবন, অর্থ ও মূল্যবান সময় নষ্ট করেছে। আর ট্রাম্পের মনোভাব বুশের চেয়েও বেশি বিপজ্জনক ও যুদ্ধংদেহী।
বুশের মতো ট্রাম্পের কাছেও শুভ (আমেরিকা) ও অশুভ (তালেবানদের অধীন আফগানিস্তান, উত্তর কোরিয়া ও সাদ্দামের অধীন ইরাক) আছে। ব্যাপার হলো, শুভ যুক্তরাষ্ট্র অশুভ কাজ করা মানুষের কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করে। তারা যদি সেটা না মানে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ‘সামরিক বিকল্প’ প্রয়োগ করতে পারে। অথবা তারা ‘ন্যায়বিচার’ প্রয়োগ করতে শাস্তিমূলক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে, তাদের ভাষা ধার করেই বললাম। বুশ যেভাবে আফগানিস্তান ও ‘অশুভ অক্ষে’ বল প্রয়োগের যুক্তি প্রয়োগ করেছেন, তাতে এক বিপর্যয়কর পরিণতি হয়। যুক্তরাষ্ট্র দ্রুততার সঙ্গে ২০০২ সালে তালেবান সরকার উৎখাত করে, কিন্তু তারা সেখানে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। আজ ১৫ বছর হয়ে গেছে, তালেবানদের হাতে এখনো বিপুল পরিমাণ ভূমি আছে। ট্রাম্প সেখানে সেনা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে প্রায় ৮০ হাজার কোটি ডলারের প্রত্যক্ষ সামরিক ব্যয় করেছে। বস্তুত, সিআইএ সেই ১৯৭৯ সালে গোপনে হস্তক্ষেপ করার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সেখানে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, যার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সেখানে হস্তক্ষেপের উসকানি দেওয়া হয়েছে।
ইরাকের বেলায় মার্কিন প্রতিক্রিয়া ছিল আরও মারাত্মক। যুক্তরাষ্ট্র মিথ্যা অজুহাতে ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করে সেখানেও ৮০ হাজার কোটি ডলারের প্রত্যক্ষ সামরিক ব্যয় করে। এতে দেশটি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে এবং লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। পরিণামে যুক্তরাষ্ট্র যা চায়নি, তা-ই এখানে ঘটছে, অর্থাৎ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে।
ইরানের ব্যাপারেও বুশের কট্টর অবস্থানের কারণে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভ করা সম্ভব হয়নি। ১৫ বছর আগের চেয়ে এখন ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বেশি। তার দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রও আগের চেয়ে উন্নত। আর তার পারমাণবিক কর্মসূচিতে যে ছেদ পড়েছে, সেটা সম্ভব হয়েছে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কূটনীতির কারণে। বুশের যুদ্ধংদেহী মনোভাব ও হুমকির কারণে সেটি ঘটেনি। উত্তর কোরিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বুশের মনোভাব একইভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে দুর্বল চুক্তি হলেও সেটার কারণে ২০০২ সালের শুরুর দিক পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচির গতি মন্থর ছিল। বুশ প্রশাসনের কট্টরপন্থীদের উপহাস এবং উভয় পক্ষের পারস্পরিক দোষারোপের মধ্য দিয়ে ২০০২ সালে এটি ভেঙে পড়ে। ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর তারা পূর্ণোদ্যমে অস্ত্র বানাতে শুরু করে। এখন তাদের হাতে পারমাণবিক বোমা ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র আছে।
এদিকে ট্রাম্প দ্বিগুণ উদ্যমে শুরু করেছেন। ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি বাতিলের ঘোষণা প্রায় দিয়েই ফেলেছেন। যদিও এতে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বাকি চার সদস্যও স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তি ছিঁড়ে ফেলা বুশ জমানার উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি ছুড়ে ফেলার শামিল হবে। এদিকে ইসরায়েল ও সৌদি আরব বিপজ্জনকভাবে ট্রাম্পের ইরান নীতি সমর্থন করছে। কিন্তু চুক্তিটি ভেঙে পড়লে উভয় পক্ষই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
উত্তর কোরিয়ার প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের মনোভাব আরও বিপজ্জনক। তিনি হুমকি দিয়েছেন, দেশটি যদি পারমাণবিক কর্মসূচি পরিত্যাগ না করে, তাহলে দেশটিকে ‘পুরোপুরি ধ্বংস’ করে দেবেন। তারা যে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি মেনে নেবে, এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ফলে পারমাণবিক যুদ্ধ লেগে যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি, যেটা ক্রমশ আরও বাড়ছে। এদিকে উত্তর কোরিয়া জোর দিয়ে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র কার্যকরভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, যদিও হোয়াইট হাউস এই ব্যাখ্যা অস্বীকার করেছে। বুশের মতো ট্রাম্পও জন এফ কেনেডির বিখ্যাত নীতি উল্টে দিয়েছেন। কেনেডি বলেছিলেন, মার্কিনদের কখনো ভয় পেয়ে আলোচনা করা ঠিক হবে না, তবে তাদের আলোচনা করতে ভীত হওয়া উচিত হবে না। বুশের মতো ট্রাম্পও আলোচনা খারিজ করে দেন। তাঁদের মনে ভয়, আলোচনায় বসলে পাছে লোকে দুর্বল ভাবে। দূরদৃষ্টি থাকলে ভবিষ্যতে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রকে নানা ফ্রন্টে সহযোগিতামূলক সম্পর্কে জড়িত হতে দেখা যেতে পারে। আর ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান অর্জন করা গেলে ইরানের ইসরায়েলবিরোধী জোশও অনেকটা থিতিয়ে আসতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের ঔদ্ধত্য রোগে ভোগে, যারা আজকের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে বিযুক্ত। সামরিকতন্ত্র বারবার ব্যর্থ হয়েছে, আগের চেয়ে সেটা এখন আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। ট্রাম্প একজন ক্ষতিকর আত্মপ্রেমী, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে রাজনৈতিক ‘জয়’ ও সন্তোষ পেতে চান। যুক্তরাষ্ট্র আবারও সে পথে আছে। তারা পারমাণবিক শক্তিধর এক প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ লাগাল বলে। অন্যান্য দেশ, নেতা ও জনমত তাকে না থামালে সে এগোতেই থাকবে। এ ক্ষেত্রে ভালো এক পথ আছে, সেটা হলো, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে পারস্পরিক নিরাপত্তার ব্যাপারে সরাসরি, স্বচ্ছ ও বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করা। যেখানে কোনো হুমকি থাকবে না। সিরিয়া, লিবিয়া, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনের প্রসঙ্গেও একই কথা প্রযোজ্য। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদই সেই আলোচনার জায়গা।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
জেফরি ডি স্যাকস: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নের অধ্যাপক।
Source: www.prothom-alo.com/opinion/article/1334071/যুদ্ধের-পথে-ট্রাম্প
Post a Comment