বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যে নারী যেভাবে পুরুষ হলো
কিশোরগঞ্জের তারাইল উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য 'স্বাধীনতা ৭১ |
নারী পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় স্বশস্ত্র যুদ্ধ শেষে বিজয়ের পতাকা হাতে উদ্যত নারী... এমন একটি ভাবনা দিতেই মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য 'স্বাধীনতা ৭১ তারাইল' গড়ে তুলছিলেন শিল্পী সুষেণ আচার্য্য। কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের এ ভাস্কর্য নিয়েই বিতর্ক এবং সমালোচনা হচ্ছে। কারণ তিনজন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে নারী চরিত্র প্রতিকৃতি বদলে গেছে পুরুষের চেহারায়।
সুষেণ আচার্য্য বলেন, "পুরো ভাস্কর্যটিই নতুন করে আবার কাজ করতে হয়েছে। আপত্তি হলো নারী থাকতে পারবে না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি যে এভাবেই রাখি। শতকথা শুনেও আমি রাখব। আমি প্রায় ছয় মাস কাজটা ঝুলায় রাখছি। অপেক্ষা করছি যে তাদের ভাবনার কোনো পরিবর্তন হয় কিনা। তাদের ভাবনার নড়চড় হয় কিনা।"
মি. সুষেণ জানান তাদের ভাবনা নড়চড় হয়নি। ভাস্কর্যের নারী তাকে বদলাতে হয়েছে পুরুষের চেহারায়। কিন্তু এই পরিবর্তনে শাড়ী পরিহিতা নারীকে পরিবর্তন করতে গিয়ে লুঙ্গী পরানো পুরুষ বানানো হয়েছে। ভাস্কর্যটি কাছ থেকে দেখেই বোঝা যায় চেহারার পরিবর্তন করার কারণে শিল্পকর্মটির মাধুর্য নষ্ট হয়েছে। ভাস্কর্যের কাছে স্থানীয়দের কেউ কেউ বলে বসলেন "এখন এটি না হয়েছে পুরুষ না হয়েছে মহিলা।" আরেকজন বলছিলেন এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানকে খাটো করা হয়েছে নারীদেরকেও অপমানও করা হয়েছে।
কিশোরগঞ্জের তারাইল উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য 'স্বাধীনতা ৭১ |
তাড়াইলে উপজেলা পরিষদের কাছে এ ভাস্কর্যের দু'শ গজের মধ্যে একটি পুরোনো মাদ্রাসা ও দুটি মসজিদ আছে। মাদ্রাসা ও মসজিদ থেকে ভাস্কর্যটি দেখা যায় বিধায় পুরো ভাস্কর্যটি নিয়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের একধরনের আপত্তি ছিল।
দারুল হুদা কাছেমুল উলুম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা ফয়েজুদ্দীন বলেন, "আমাদের একটু বাজে। ধর্মীয় দৃষ্টিতে একটু বাজে আরকি। এডার ব্যাপারে আমাদের এলাকার সাধারণ জনগণেরই পক্ষ থেকেই মন্তব্য ছিল।"
নারীর স্থলে পুরুষ করা হলে এখন কী মত জানতে চাইলে মি. ফয়েজুদ্দীন বলেন, নারী নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য ছিল না। তারা চেয়েছিল পুরো ভাস্কর্যটিতেই মানুষের পরিবর্তে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বিমূর্ত কিছু দিয়ে এটি উপস্থাপন করা যায় কিনা।
এই মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির একজন সদস্য এবং তাড়াইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আজিজুল হক ভুইয়া মোতাহার জানান স্থানীয়ভাবে এ ভাষ্কর্য নিয়ে কথা ওঠায় তারা নকশায় কিছুটা পরিবর্তনের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
"আমরা বলেছি যে নারীটাকে দক্ষিণ দিকে আনার জন্য আর কিছু না। আর পুরুষটাকে উত্তর দিকে নেয়ার জন্য। আলেম ওলামারা কেউ এটা নিয়ে প্রতিবাদও করে নাই। আমরাই বলছি যে যেহেতু আলেম ওলামারা বলে যে ওযু নষ্ট হয়ে যায়গা ওইটা (নারী) ওইদিকে ফিরায় দাও।"
ভাস্কর্য উলঙ্গ কী করে হয় এ প্রশ্নে তিনি বলেন, "উলঙ্গ নাতো কী? একটা মহিলা হাত উচু করে এমনভাবে দাঁড়ায় আছে। একটা মহিলারে এমনভাবে বিশ্রি কইরা খারা করছে, দেখলেই খারাপ লাগে।"
আওয়ামী লীগের এই নেতার বক্তব্যেই বোঝা যাচ্ছে ভাস্কর্যটি নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী কী ছিল। এ ভাস্কর্য নারী বদলে পুরুষ করার কোনো প্রশাসনিক নির্দেশনা দেয়া হয়নি। এ ভাস্কর্যটি নির্মিত হচ্ছে জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে। কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান বলেন এটি একটি সামান্য বিষয়। এটাকে এত বড় করে দেখার কিছু নেই। টেলিফোনে তিনি বিবিসিকে বলেন, "এটা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছে সেভাবেই হয়েছে"।
রাজনীতিক নেতৃবৃন্দের নির্দেশনায় নারী বদলে পুরুষ করায় ক্ষুব্ধ হয়েছে স্থানীয় নারী সংগঠনগুলো। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কিশোরগঞ্জ শাখার সভানেত্রী মায়া ভৌমিক বলেন, "এ বিজয়ের মাসে আমরা এটা কল্পনাই করি নাই। এ কাজটা এমন এটা আমাদের পিছায় দেবে। এটা একটা পুরুষ তান্ত্রিকতা। নীতি নির্ধারণীর যায়গা থেকে যদি আমাদের পুরুষতান্ত্রিকতার ভাবটা আমরা না সরাতে পারি তাইলে আমরা মুখে যতই বলি বাস্তবে কোনো উন্নয়ন হবে না।"
কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যে নারীকে পুরুষের চেহারায় পরিবর্তন করার বিষয়টিকে জেলা পরিষদ এবং স্থানীয় ক্ষমতাসীনরা বলছে তুচ্ছ ঘটনা। কিন্তু বিশ্লেষকদের অনেকেই বাংলাদেশে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী এবং রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাবকে তুলে ধরতে এ ঘটনাকেই সামনে আনছেন।
http://www.bbc.com/bengali/news-42452158
Post a Comment