Header Ads

test

রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস

মোহাম্মদ গোলাম নবী:
বিশ্বে প্রায় ২০ লাখ রোহিঙ্গা আছে। যার মধ্যে ৮ লাখ মায়ানমারে এবং বাংলাদেশে আছে ৫ লাখের বেশি। বাকিরা সৌদি আরব, ভারত, নেপাল, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, ফিলিপাইনসহ অন্যান্য দেশে বসবাস করে।জাতিসংঘের তথ্য মতে, রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত ও রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠী।
চৌদ্দশ শতক থেকে প্রায় ৩০০ বছর রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি ২২ হাজার বর্গমাইলের রোহাঙ্গা একটি স্বাধীন ভূখন্ড ছিল।তৎতকালীন বার্মা ও বর্তমানের মায়ানমারের বৌদ্ধ রাজার দখলের মধ্য দিয়ে এটি প্রথম পরাধীন হয়, এরপর ব্রিটিশরা মায়ানমার দখল করলে রোহাঙ্গাও ব্রিটিশ শাসনের অধীন হয়। ব্রিটিশরা মায়ানমার দখল করে একটি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা তৈরি করেছিল কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেই তালিকায় রোহিঙ্গাদের নাম উঠানো হয়নি। ১৯৪৮ সালে মায়ানমার বৃটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। এসময়ে মায়ানমারের সংসদে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি ছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালে সামরিক শাসক জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখলের পর রোহিঙ্গাদের নাম জাতিগোষ্ঠীর তালিকায় না থাকায় তাদেরকে বিদেশী হিসেবে গণ্য করে নিপীড়ন নির্যাতন চালাতে থাকে। সেই ১৭৮৫ সালে যখন বৌদ্ধ রাজা আরাকান দখল করেছিল তখন যেমন রোহিঙ্গারা পালিয়ে চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল ঠিক একইভাবে সামরিক শাসকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ রোহিঙ্গারা বার বার বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
আর এলক্ষ্যে মুসলিম দেশগুলোর সর্বাগ্রে সোচ্চার হওয়ার কথা থাকলেও তারা ওআইসি-র মাধ্যমে খুবই ধীরগতিতে ও মৃদু ভঙ্গিতে কূটনীতি করছে। বরং খৃষ্টানদের ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস অত্যন্ত দৃঢ়ভঙ্গিতে গতকাল মায়ানমারকে বলেছেন- রোহিঙ্গাদের পূর্ণ অধিকার দিতে হবে। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রার্থনায় বলেছিলেন যে, রোহিঙ্গারা ভালো মানুষ, শান্তিপ্রিয় মানুষ, তারা খৃষ্টান নয়, কিন্তু তারা ভালো। তারা আমাদের ভাই ও বোন। এবং তারা দীর্ঘকাল ধরে নির্যাতিত।
এদিকে ব্রিটিশ শাসনামলে চট্টগ্রাম থেকে হাজার হাজার বাঙ্গালী কাজের সন্ধানে আরাকানে গিয়ে বসতি গড়েছিল। ফলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রভাব লক্ষণীয়। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে ব্রিটিশ শাসনামলে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ ভারতীয় যাদের মধ্যে বাঙ্গালীও রয়েছে তারা ব্যবসা বাণিজ্য, কৃষিকাজসহ নানান কাজে তত্কালীন বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনসহ বিভিন্ন নগরে ও জনপদে গিয়ে আর ফেরত আসেনি। অভিবাসীদের সঙ্গে স্থানীয় বার্মিজদের সংঘাত সংঘর্ষের ইতিহাস অনেক পুরনো। আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমান ও রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যে সংঘাত সেই যে শুরু হয়েছিল সেটা আর পুরোপুরি থামেনি। এদিকে রোহিঙ্গা মুসলমানরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিল। ফলে জাপানীরা রোহিঙ্গাদের নির্যাতন নিপীড়ন শুরু করলে ১৯৪৭ সালে প্রায় ২২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। এভাবে শত শত বছর ধরে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেওয়া এবং ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগ বাংলা ভাষাভাষি হয়ে গেছে। রোহিঙ্গারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাধীন আরাকান মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বার্মিজ সরকারের কোপানলে পড়ে। নে উইনের সামরিক অভিযানের তীব্রতায় ১৯৭৮ সালে নতুন করে প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। এরপর ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব আইন করে রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রবিহীন করে দেওয়া হয়। ১৯৯১-৯২ সালে নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে আবার প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
নোবেলে শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সুচির দল ক্ষমতায় আসার পর রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ হবে বলে অনেকে আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু সেটা হয়নি। ২০১২ সাল থেকে নতুন করে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা মুসলমান নির্যাতন ২০১৫ সালে অং সান সুচির দল ক্ষমতায় আসার পর বরং বেড়েছে। রোহিঙ্গা মুসলমানরা মায়ানমারের নাগরিক না হওয়ায়তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত।এই যে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গা সমস্যা ধীরে ধীরে জটিল থেকে জটিলতর হলো সেখানে বিশ্বের শক্তিশালী মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকা তেমনভাবে দেখা যায় না। মুসলিম ভ্রাতৃত্বের কথা বলা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো রোহিঙ্গা মুসলমানদের পাশে সেভাবে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে গত পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে।
মুসলিম দেশগুলোর ধীর চলো নীতির মধ্যেই জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট মায়ানমারের প্রেসিডেন্টের হাতে হস্তান্তর করা হয় যেখানে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন সংস্কারের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে কাজ করার জন্য বলা হয়েছে। সেসঙ্গে রোহিঙ্গাদের উপর যা করা হচ্ছে তাকে মানবতার চরম লংঘন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টের পর্যবেক্ষণে একথাও বলা হয়েছে যে, মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর উপর সু চি-র কার্যকর প্রভাব নেই। এই অবস্থায় আনান কমিশনের রিপোর্ট কতোটা বাস্তবায়ন হবে সেনিয়ে কিছুটা সন্দেহ থেকে যায় বৈকি। তবে রিপোর্ট প্রকাশের পরপরই রোহিঙ্গাদের উপর নতুন করে নির্যাতনের স্টিম রোলার চালু হয়েছে যেন। আনান কমিশনসহ বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বেশিরভাগই মনে করে যে, রোহিঙ্গা সমস্যা মায়ানমারকেই সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষও তাই চায়। কিন্তু নির্যাতিত শিশু, নারী ও বয়স্ক মানুষেরা যখন জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসছে তখন তাদেরকে আশ্রয় দেওয়ার পক্ষেও অনেক বাংলাদেশী।
এদিকে বিগত ৪ দশক ধরে বাংলাদেশে আগত কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশীদের বিয়ে করাসহ নানান প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমাজে মিশে গেছে। কক্সবাজারের শরনার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের চেয়েও সমাজে মিশে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেশি। এমনকি কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশী পাসপোর্টে বিদেশী চাকরি করতে গিয়েছে। অভিযোগ আছে বিদেশে বিশেষ করে মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে লিপ্ত বাংলাদেশীদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা। কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণের মধ্যেও রোহিঙ্গাদের নিয়ে ভীতি রয়েছে। অবস্থা এমন যে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ধারণ করার মতো আর্থ সামাজিক অবস্থা বাংলাদেশের নেই। আবার তাদেরকে ঠেলে বের করে দেওয়া কিংবা নির্যাতনের শিকার মানুষদের আশ্রয় না দেওয়ার মতো নিষ্ঠুরতাও বাংলাদেশ কখনো দেখায়নি, দেখাতে পারবেও না। যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মানুষ নির্যাতনের স্বরূপ দেখেছে ১৯৭১ সালে। বলা হয় রোহিঙ্গারা এখন ১৯৭১ সালের চেয়েও কঠিন সময় পার করছে।
এই অবস্থায় মায়ানমারের উপর তীব্র আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করার কোন বিকল্প নেই যাতে করে মায়ানমার আনান কমিশনের রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী রোহিঙ্গা মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করে। তাদেরকে নাগরিকত্ব প্রদানের মাধ্যমে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার দেয়। আর এলক্ষ্যে মুসলিম দেশগুলোর সর্বাগ্রে সোচ্চার হওয়ার কথা থাকলেও তারা ওআইসি-র মাধ্যমে খুবই ধীরগতিতে ও মৃদু ভঙ্গিতে কূটনীতি করছে। বরং খৃষ্টানদের ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস অত্যন্ত দৃঢ়ভঙ্গিতে গতকাল মায়ানমারকে বলেছেন- রোহিঙ্গাদের পূর্ণ অধিকার দিতে হবে। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রার্থনায় বলেছিলেন যে, রোহিঙ্গারা ভালো মানুষ, শান্তিপ্রিয় মানুষ, তারা খৃষ্টান নয়, কিন্তু তারা ভালো। তারা আমাদের ভাই ও বোন। এবং তারা দীর্ঘকাল ধরে নির্যাতিত। তারা শুধু ইসলাম ধর্মে তাদের বিশ্বাসের কারণে নির্যাতন ও হত্যার শিকার হচ্ছে। তারা মায়ানমার ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তারা যাচ্ছে কিন্তু কেউ তাদেরকে চায় না। এরকম এক অবস্থার মধ্য আগামী নভেম্বরে পোপ ফ্রান্সিস বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
মুসলমান রোহিঙ্গাদের পাশে যখন মুসলিম বিশ্বের বাঘা বাঘা দেশগুলো প্রয়োজনীয় শক্তি ও সাহস নিয়ে দাড়াচ্ছে না তখন পোপ ফ্রান্সিসের এই প্রার্থনা ও চাপ প্রয়োগ খুবই তাত্পর্যপূর্ণ এবং আশান্বিত হওয়ার মতো বিষয়।

No comments

Thanks for your valuable comment!